
প্রকাশিত: Fri, Dec 9, 2022 10:21 PM আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 6:21 AM
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস বনাম সংগঠনের ছড়াছড়ি, সাফল্যের চাইতে ব্যর্থতাতেই ঘোরাঘোরি
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : ১০ ডিসেম্বর। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে এবং ১৯৫০ সালের এই দিনটিকে যার যার মতো করে উদযাপন করার আহ্বান জানানো হয়। অবশ্য মানবাধিকার বিষয়টি জাতিসংঘের বহু আগে ১৭৮৯ সালের ২৬ আগস্ট ফ্রান্সের সাংবিধানিক পরিষদে উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব জরমযঃং ড়ভ গধহ ধহফ ড়ভ ঃযব ঈরঃরুবহ গৃহীত হয়। এতে ব্যক্তি মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়। জাতিসংঘ সেই আলোকেই মানুষের সার্বজনীন অধিকার রক্ষার জন্য পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র ও জাতিসমূহের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলো। মোট ১৭ টি অনুচ্ছেদে মানুষের স্বাধীন সত্তার বিকাশ, অধিকারভোগ, সম্পত্তি অর্জন ও ভোগ, জীবনের নিরাপত্তা রক্ষা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার অধিকার, মতামত প্রকাশ ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমতা, কোনো মতামত প্রকাশে জন শৃঙ্খলা বিঘ্নিত না করা ইত্যাদি বিষয় রাষ্ট্রসমূহ আইনানুগ প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিশ্চিত করার দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মূলত ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ও জাতিসংঘের মধ্যে সময়ের পার্থক্য থাকলেও মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবীকে সকল মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য করার উদ্দেশ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। পৃথিবীতে নানা দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র বসবাস করছে। এখনো অনেক দেশ, অঞ্চল, জাতিগোষ্ঠী নানা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সামাজিক, জাতিগত, ধর্মীয় বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। মূলত ক্ষমতা বিত্ত ও শ্রেণির কর্তৃত্ব এই বৈষম্যকে নিরন্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতিতে মানুষের সমান অধিকার জন্মগত। সমাজব্যবস্থার সেই প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেকারণেই মানুষে মানুষে অসাম্য, বৈষম্য, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিপীড়ন, অত্যাচার ইতিহাসে অনুষঙ্গ হয়ে চলে এসেছে, এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই দার্শনিক মানবতাবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ সচেতন মানুষ সবসময় নানা উদ্যোগ, প্রতিষ্ঠান এবং কার্যকর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু সর্বজনীন মানবাধিকার অর্জনের বিষয়টি মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। এরজন্য দেশে দেশে বিপ্লব, স্বাধীনতা, মুক্তির আন্দোলন এবং জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের ঘোষণাপত্র গ্রহণের উদ্যোগটিকে মোটেও হাল্কা করে দেখার নয়।
১৯৪৮ পরবর্তী সময় থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের প্রচার প্রচারণা যেমন হয়েছে, নানা উদ্যোগ, সহযোগিতা আন্তর্জাতিক এই সংস্থা থেকেও নেওয়া হয়েছে। এইসবই ইতিবাচক দিক। গত ৭২ বছর ধরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অসংখ্য সংগঠন এই লক্ষ্য পূরণে কাজও করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও বিশ্ব বাস্তবতার মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, শ্রেণি স্বার্থ, আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব পরায়ণতা, প্রভুত্ব রক্ষা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী প্রবণতা কমবেশি সব দেশেই বিরাজমান এবং কোনো না কোনোভাবে প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। ফলে নিরীহ মানবাধিকারের বিষয়সমূহ ক্ষমতা ও শক্তির প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন ব্যবহারে জটিল আকার ধারণ করছে। মানবাধিকার তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর ধারে কাছেও যেতে পারছে না। পৃথিবীতে এখন দেশে দেশে মানবাধিকার নানা নামের সংগঠন গড়ে উঠেছে। এগুলোর বেশিরভাগই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা আন্তরিক এবং নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করে আসছিলো তাদেরকেই নানাভাবে কাজে বাঁধা প্রদান করে আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে এখন শতাধিক বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন গড়ে উঠেছে। যাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বাস্তব কর্মের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আঞ্চলিক নানা মানবাধিকার সংগঠনও একইভাবে ডালপালা বিস্তার করে পৃথিবীব্যাপী মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হওয়ার চেষ্টা করছে। দেশে দেশে তাদেরই নানা ধরণের মানবাধিকার সংগঠন নামধারী প্রতিষ্ঠান নানা ইস্যুতে সোচ্চার হচ্ছে যা শেষ বিচারে মানবাধিকারের পক্ষে তো নয়ই বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের পক্ষেই অবস্থান নিতে দেখা যায়। এদের হাতে রয়েছে বিপুল অর্থবিত্ত, প্রচারমাধ্যম, গণমাধ্যমও একইসঙ্গে তথাকথিত নাগরিক সমাজের ছদ্মাবরণে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে মানবাধিকারের কর্মী, সংগঠক এবং প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবেও ভূমিকা রাখতে দেখা যায়, যারা পুরো মানবাধিকারের আদর্শকেই বিভাজনের টানাটানিতে ফেলে দিয়েছে। এর ফলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত মানবাধিকার প্রত্যাশীদের চাহিদা। তাদের পক্ষে দাঁড়ানো সংগঠনের অভাব যেমন রয়েছে, আর্থিক, আইনগত ও অন্যান্য সুযোগসুবিধাও প্রয়োজনে পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো বিষয়টিই এখানে প্রভাবশালী, কর্তৃত্বশালী ও বিত্তশালীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে অনেক বেশি সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাদেরকে প্রায়শই যারা সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তাদেরই পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। আবার যারা অপরাধীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের পক্ষে এদের অবস্থান খুব একটা দেখা যায় না। এর ফলে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো শোষক এবং শোষিতের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তা ঘুচিয়ে আনতে অনেক শক্তিই চায়না। সেকারণে তারা মানবাধিকার সংগঠন নামে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, দেশীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে নানা সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। যেগুলো শোষিতের পক্ষে কাজ করার জন্য চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছে। নানা অপপ্রচার, মিথ্যাচার এবং অপকৌশল ব্যবহার করে এরা এমনকি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব সংগঠন নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধেই অবস্থান দাঁড় করাচ্ছে। পুরো বিষয়টিই এখন তাই বেশ ঘোলাটে।
কোন সংগঠন সত্যিকার অর্থে মানবাধিকারের পক্ষে, আবার কোন সংগঠন গোপনে এর বিরুদ্ধে কাজ করছে- সেটি অনেকের পক্ষেই বোঝা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠছে। মানবাধিকার সংগঠনের এত ছড়াছড়ি, কাড়াকাড়ি ও বাড়াবাড়ি যা নিয়ে পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভ করাই অনেক সময় অনেকের পক্ষে কষ্টকর হয়ে যায়। এখানে আন্তর্জাতিক নানা অপশক্তির কারসাজি রয়েছে, মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলার কৌশলও কাজ করছে। হুটহাট কোনো কোনো দেশে এমন কিছু সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে যা নিয়ে হইচই ফেলে দেওয়া হয়, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় নানা সামাজিক গণমাধ্যম বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাতে অনেক সময় ঢাকা পড়ে যায় প্রকৃত সত্য। ভেসে ওঠে অনেক মিথ্যা তথ্য। আমাদের দেশেও মানবাধিকার সংগঠনের নামে কিছু কিছু সংগঠন দেশীয় নানা বিষয়াদি নিয়ে বিদেশে প্রচার করার চেষ্টা করে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য মানবাধিকার রক্ষা নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে যারা মানবাধিকার হরণকারী, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক এমনকি জঙ্গিবাদী যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা। সবকিছুই করা হয় মানবাধিকার রক্ষার নামে।
পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেই মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে আন্তরিক যেমন সংগঠন যথেষ্ট রয়েছে আবার লবিষ্ট নিয়োগের মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করে মানবাধিকারবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেও রক্ষা করার মতো প্রতিষ্ঠান কাজ করে চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচাইতে ধনী এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে পরিচিত। প্রায় ২৫০ বছরের দেশটি পৃথিবীতে এখন ধন ও সম্পদে সবচাইতে সম্পদশালী। কিন্তু সেই দেশেও বৈষম্য দূর হয়নি। সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত তো হয়ইনি, বরং প্রতিমুহূর্তে লঙ্ঘিত হচ্ছে। বর্ণবাদের শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। জাতিগত বিভেদ উসকে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার ঘটনা ঘটছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট, গির্জা, সড়কপথ সবর্ত্রই আকস্মিকভাবে বন্দুক শিকারীর ক্রীড়নকে পরিণত হতে হচ্ছে। এই প্রবণতা এখন অন্যান্য দেশেও কমবেশি ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে দেশে ধর্ম, জাতিগত ও বর্ণ পরিচয় বড় ধরণের মানবাধিকারের সমস্যা হয়ে উঠছে। এসবকে মোকাবেলা করার জন্য যে ধরণের আদর্শিক মানবতাবাদী শিক্ষা, রাজনীতি সচেতনতা, সাংস্কৃতিক বোধ, মূল্যবোধ, আইন, বিবেক ও সচেতনতাবোধের প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সকল পক্ষের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিলো- সেটি ভয়ানকভাবে অনুপস্থিত দেখা যাচ্ছে। এর ফলে যতই আমরা মানবাধিকার দিবস পালন করি না কেন কিংবা নানা সংগঠনের নাম শুনি না কেন, কিন্তু তাতে খুব বেশি মানবাধিকার অর্জিত হওয়ার আশা করা যাচ্ছে না। তারপরও সত্যিকার মানবাধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করার আদর্শিক লড়াই অব্যহত রাখতে হবে এবং সহমত পোষণকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক মহলকে একযোগে কাজ করতে হবে। লেখক: শিক্ষাবিদ
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
